কুটির শিল্প কি / কুটির শিল্প কাকে বলে ? উদাহরণ, বৈশিষ্ট্য

কুটির শিল্প কি বা কুটির শিল্প কাকে বলে? কুটির শিল্প বলতে কি বুঝায় এবং কুটির শিল্পের উদাহরণ ও বৈশিষ্ট্য।

জেনেনিন কুটির শিল্পের অতীত, কুটির শিল্পের বর্তমান, কুটির শিল্পের প্রকারভেদ, কুটির শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার কারণ, বর্তমান অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির উপায়, কুটির শিল্পের প্রভাব, কুটির শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।

আর্টিকেল সূচী:

কুটির শিল্প কি বা কুটির শিল্প কাকে বলে ?

কুটির শিল্প

“কুটির” কথাটির আক্ষরিক অর্থ তৃণ বা পত্রনির্মিত দরিদ্র বাসগৃহ।

কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই যখন কুটিরে বসে পারিবারিক পরিবেশে, অল্প পুঁজিতে, অবসরে দক্ষ ও অদক্ষ কারিগর কর্তৃক যে সকল শিল্পদ্রব্য উৎপাদিত হয়, সেই শিল্পকে বলে কুটির শিল্প।

আঠারো শতক পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে কুটির শিল্প ছিল প্রধান শিল্প। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে এককালে কুটির শিল্পের ভূমিকাই ছিল অগ্রণী।

বাংলাদেশে সেই অতীতকাল থেকেই কুটির শিল্পের প্রচলন ছিল। কুটির শিল্প এ দেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাহক।

কুটির শিল্পের অতীত

অতীতে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল। ঢাকার মসলিন একসময় সারা বিশ্ব থেকে বাংলার সুখ্যাতি বয়ে এনেছিল।

বাঁশ, বেত, কাঠ, ধাতব, তাঁত, বিড়ি, মৃৎশিল্প প্রভৃতি কুটির শিল্পের কারুকার্যময় জিনিস একসময় বাংলার ঘরে ঘরে শোভা পেত।

প্রাত্যহিক প্রয়োজনে গ্রামের মানুষ স্ব স্ব মর্যাদা ও বংশের ধারায় কুটির শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু আঠারো শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর আমাদের কুটির শিল্প ক্রমে ধ্বংসের দিকেঅগ্রসর হয়েছে।

কুটির শিল্পের বর্তমান

ইংরেজ আধিপত্যে কুটির শিল্পের ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে এ শিল্প নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ করে নিল।

ঢাকাই মসলিন হারানোর দুঃখ কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া হয়েছে জামদানি শাড়ি ও রাজশাহীর রেশম সিল্কের শাড়ির মাধ্যমে।

অনুরূপ গৃহ নির্মাণে পোড়ামাটির সৌকর্যময় কাজ হারানোর দুঃখও অনেকটা মিলিয়ে গেল শৈল্পিক মৃৎশিল্পের পুনরুত্থানের দ্বারা।

বর্তমানে আবার কুটির শিল্পের কদর বেড়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে।

 

কুটির শিল্পের প্রকারভেদ

বাংলাদেশের কুটির শিল্পকে নির্মাণসামগ্রীর বিভিন্নতা অনুসারে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।

কুটির শিল্পের উদাহরণ: তাঁতশিল্প, রেশমশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতবশিল্প, বেতশিল্প, শঙ্খশিল্প ও কাগজশিল্প।

ঢাকার মসলিন

ঢাকার মসলিন এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন গ্রিস, রোম ও পারস্যের রাজকুমারী ও সম্রাজ্ঞীদের জন্য এটি ছিল পরম আকাঙ্কিত বস্তু। এটি পৃথিবীর মানুষের কাছে বিস্ময়ের ঘোর লাগিয়ে দিয়েছিল।

তাঁত ও জামদানি

মসলিন ধ্বংস হওয়ার পর সেই গৌরব অনেকটা কাটির ফিরিয়ে এনেছে জামদানি শাড়ি।

বিদেশে এই শাড়ির কদর উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি পাবনা বিটি ও তাঁতের শাড়ি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এখন অত্যন্ত জনপ্রিয়।

কুমিল্লার খাদি কাপড় আজও আমাদের তাঁতশিল্পের জন্য গৌরবের। বাংলাদেশের প্রয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁতশিল্পের ভূমিকা অনেক।

তাঁতের তৈরি শাঁড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ধুতি ও জীবনে অতীব প্রয়োজনীয়। বিছানার চাঁদর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতীব প্রয়োজনীয়।

রেশমশিল্প

কুটির শিল্পের মধ্যে রাজশাহীর রেশমশিল্প একটি সুত্র বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এ শিল্প একসময় গুণগত মান ও উৎকর্ষে বিশ্বখ্যাত ছিল।

রংপুর, দিনাজপুরেও এ শিল্প বিস্তার লাভ করেছে।

কাগজ ও প্লাস্টিক শিল্প

বাংলাদেশের কুটির শিল্প গ্রামীণ সীমানা ছাড়িয়ে শহরেও প্রভাব বিস্তার করেছে।

শহরের স্বল্প আয়ের মানুষ কাগজ ও প্লাস্টিকের নানাবিধ ফুল তৈরি করছে। আর এ ফুল দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

মৃৎশিল্প

পোড়ামাটির টালি, শৈল্পিক কারুকার্য, মূর্তি, গৃহে ব্যবহারযোগ্য ও প্রদর্শনযোগ্য ছোটখাটো জিনিসপত্র যেমন: পেপার ওয়েট, অ্যাসট্রে, মাটির ব্যাংক, পশুপাখি, মাছ, মেয়েদের অলংকার প্রভৃতি।

প্রায় সব মেলায় এর বিপুল উপস্থিতি ও সমাদর লক্ষণীয়।

বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈজসপত্র

সিলেটের বেতের টেবিল, চেয়ার, সোফাসেট এখন আভিজাত্যের প্রতীক।

প্রচুর পরিমাণে বাঁশের তৈজসপত্র সাধারণ ও শৌখিন ব্যবহারে কাজে লাগছে।

কাঠের তৈরি জিনিসপত্র সর্বত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে।

ধাতব কাজ

অলংকার নির্মাণে সোনা ও রূপার কদর এখনো প্রশ্নাতীত। পিতল, কাঁসা ও লোহার তৈজসপত্র বিপুলভাবে সমাদৃত। এসবের কোন বিকল্প নেই বললেই চলে।

লবণ ও বিড়ি

খাদ্যদ্রব্যের উপকরণ লবণের সবটাই কটির সংবাদ নবজাত। প্রধানত কক্সবাজার ও চট্টগ্রামেই লবণ উৎপাদিত হয়।

আর ধূমপানের উপকরণ বিড়ি কুটির শিল্পের মধ্যে একসময়ের ভূমিক সবচেয়ে বড় শিল্প।

চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য

যান্ত্রিক শিল্পের দখলে চলে গেলেও মানষ কুটির শিল্প চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি প্রস্তুতেও যথেষ্ট এগিয়ে আছে।

চামড়ার পোশাক, চামড়ার ব্যাগ ও জুতো, শৌখিন দ্রব্যাদি এ শিল্পের আওতাভুক্ত।

গণ-আসন

শীতলপাটি, মাদুর ও নকশিকাঁথা গণ-আসন হিসেবে এ দেশে স্বীকৃত। আর এর সবটাই কুটির শিল্পের আওতায় তৈরি হয়। এগুলো ঐতিহ্যসচেতনতা ও রুচির পরিচয় বহন করে।

কৃষি উপকরণ

কৃষিকাজের জন্য নির্মিত মই, লাঙল থেকে শুরু করে দা, কাঁচি, কোদাল প্রভৃতি কুটির শিল্পজাত উপকরণ।

কুটির শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার কারণ

কুটির শিল্পের বর্তমান দূরবস্থার প্রধান কারণ ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র। আর দ্বিতীয় কারণ শিল্পবিপ্লব।

কুটির শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে যন্ত্রে উৎপাদিত পণ্য সুন্দর, সুগঠিত ও নিপুণ এবং দামেও অনেক সস্তা।

কাজেই দেশীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। আর এর ফলে ধ্বংসের দ্বার উন্মুক্ত হয়।

বর্তমান অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির উপায়

কুটির শিল্পের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা থেকে পরিত্রাণের প্রধান উপায় গণসচেতনতা।

আর দ্বিতীয় প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও আগ্রহ।

এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থাগুলোর কুটির বা শিল্প স্থাপনে আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং এই শিল্পের বাজার নিশ্চিত করা। এ শিল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা।

বাংলাদেশের কুটির শিল্পকে উৎসাহিত ও সম্প্রসারিত করার জন্য বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

এই সংস্থাটি যদি কুটির শিল্পকে উৎসাহিত করে, পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে, তবে এ শিল্প তার হারানো গৌরব উদ্ধার করতে সক্ষম হবে।

কুটির শিল্পের প্রভাব

আমাদের দেশে শুধু শিল্পক্ষেত্রেযেমনয়, সামাজিক সংবাদ জীবনেও কুটির শিল্পের অবদান অপরিসীম।

কুটির শিল্পকে কেন্দ্র করে ফলে গড়ে উঠেছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তারা বংশানুক্রমে জীবিকা অর্জনের সর্বসা জন্যে শিল্পের নাম অনুসারে বংশ ও জাতি হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

জনত কামার, কুমার, মিস্ত্রি, ছুতার ইত্যাদি জাতির উদ্ভব এভাবে।

কুটির শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মানুষের প্রব মনের টান চিরন্তন। অনুভূতির স্পর্শ পেতে হলে কুটির শিল্পের দ্বারস্থ হতে হয়।

কুটির শিল্পের সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনই সম্ভাবনাও প্রচুর। মূলত কুটির শিল্পকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে দেশীয় শিল্প চাঙ্গা করা যায়।

এ শিল্পের মাধ্যমে বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আবার বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হবে।

কুটির শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা সম্ভব।

উপসংহার

মূলত কুটির শিল্পের লালন ও বর্ধনের জন্য সরকারের বলিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন।

যন্ত্রশিল্পের পাশাপাশি কুটির শিল্পের যথার্থ শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতেই দেশের প্রকৃত শিল্পোন্নয়ন ও বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব।

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এবং ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে কুটির শিল্পের প্রতি জনগণকে আকৃষ্ট ও সচেতন করতে পারলে এ শিল্পের প্রসার অবশ্যম্ভাবী।

তাহলে কুটির শিল্প কি বা কুটির শিল্প কাকে বলে, কুটির শিল্পের উদাহরণ, বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ এসব কিছু আশা করি আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন।

কুটির শিল্প কি: FAQ

কুটির শিল্প কাকে বলে?

আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই কুটিরে বসে পারিবারিক পরিবেশে, অল্প পুঁজিতে, অবসরে দক্ষ ও অদক্ষ কারিগর কর্তৃক শিল্পদ্রব্য উৎপাদিত হলে সেই শিল্পকে বলে কুটির শিল্প।

কুটির শিল্পগুলো কি কি?

কয়েকটি কুটির শিল্পের নাম হলো তাঁতশিল্প, রেশমশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতবশিল্প, বেতশিল্প, শঙ্খশিল্প ও

Leave a comment